সারাদেশ

শিশু সিয়াম জানে না তার বাবা বেঁচে নেই

‘আমার অবুঝ শিশুকে কীভাবে বোঝাবো ওর বাবা বেঁচে নেই। ও তো দেড় বছরের বাচ্চা, এখনো কথা বলতে পারে না। শুধু ‘বাপ’ ডাকতে পারে। কয়দিন ধরে খালি বাপ বাপ ডাকছে। কিন্তু ওর বাপ যে আর এ দুনিয়াতে নাই, কোনো দিনও যে আর আসবে না, সেটা তো আমার অবুঝ বুকধন জানে না।’

সোমবার (২৯ জুলাই) দুপুরে জল টলমল চোখে এভাবেই কথা বলছিলেন স্বামী হারানো মুন্নী বেগম (২৪)।

গত ১৮ জুলাই রংপুর নগরীর মডার্ন মোড়ে তাজহাট থানা এলাকায় পুলিশের সঙ্গে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীসহ দুষ্কৃতকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অটোচালক মানিক মিয়ার (৩৪) মৃত্যু হয়। নিজের চায়ের দোকানের মালামাল কিনতে স্ত্রীকে দোকানে রেখে মডার্ন মোড় এলাকায় এসেছিলেন তিনি।

নিহত মানিক মিয়া রংপুর নগরীর ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব ঘাঘটপাড়া এলাকার মৃত সেকেন্দার আলীর ছেলে। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে মানিক মিয়া ছিলেন দ্বিতীয়। স্বামীকে হারিয়ে দেড় বছরের শিশুসন্তান সিয়ামকে নিয়ে অকূলপাথারে পড়েছেন গৃহবধূ মুন্নী বেগম।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মানিক মিয়া অটোরিকশা চালানোর পাশাপাশি রংপুর নগরীর আরকে রোড সংলগ্ন শুঁটকির আড়ত এলাকায় রাস্তার ধারে চায়ের দোকান করতেন। ঘটনার দিন বিকেল ৪টার দিকে স্ত্রীকে চায়ের দোকানে রেখে তিনি অটোরিকশা নিয়ে দোকানের কিছু মালামাল আনতে যান মডার্ন মোড় এলাকায়। এরপর ফেরার পথে বিকেল ৫টার দিকে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এলাকায় পৌঁছলে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা শিক্ষার্থী ও দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে পুলিশের কয়েক দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া থেকে একপর্যায়ে সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ও গুলি ছোড়ে। এ সময় অটোচালক মানিক মিয়া গুলিবিদ্ধ হন।

পরে স্থানীয়রা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পরদিন ১৯ জুলাই বিকেল আড়াইটার দিকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। ওই দিন বাদ আসর জানাজা শেষে বাড়ির পাশে মানিক মিয়াকে দাফন করা হয়।

অটোচালক মানিক মিয়া ছিলেন পরিবারের ভরসা। বাবা সেকেন্দার আলী ১২ বছর আগে মারা যান। এরপর বৃদ্ধ মা, ছোট ভাই ও বোনদের দায়িত্ব পড়ে মানিকের ঘাড়ে। ২০১৮ সালে মানিক-মুন্নী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। দেড় বছর আগে তাদের সংসারে জন্ম নেয় শিশু সিয়াম।

তিন শতক জমির ওপর টিনশেডের দুটি ঘরে তাদের বসবাস। মানিক মিয়া অটোরিকশা চালানোর পাশাপাশি চায়ের দোকানের রোজগার থেকে দুই বোন কুলসুম ও শিউলির বিয়ে দিয়েছেন। এখন উপার্জনক্ষম সেই মানিককে হারিয়ে অন্ধকার দেখছেন পুরো পরিবার।

আজ সোমবার দুপুরে মানিক মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্ত্রী মুন্নী বেগম দেড় বছরের সিয়ামকে কোলে নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। মানিকের মা নুর জাহান বেগম (৫৫) সন্তান হারিয়ে বাকরুদ্ধ। এখন বিছানায় শয্যাশায়ী।

মুন্নী বেগম বলেন, ‘ঘটনার দুই দিন আগে ১৬ জুলাই মঙ্গলবার বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এই মৃত্যুকে ঘিরে রংপুর নগরীতে আন্দোলনরতদের সঙ্গে পুলিশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তাই স্বামীকে অটোরিকশা নিয়ে বের হতে দিইনি। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টার দিকে চায়ের দোকানে মানিকের জন্য খাবার নিয়ে যাই। এর পর আমাকে দোকানে রেখে অটোরিকশা নিয়ে মডার্ন মোড় এলাকায় দোকানের মাল আনতে যায় মানিক।’

‘গুলিবিদ্ধ হওয়ার দুই মিনিট আগেও মোবাইল ফোনে কথা হয়। তখন সে বলে পুলিশ-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছে। বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা পাচ্ছি না। তুমি দোকানে থাকো, একটু পরেই আসছি। এর কিছুক্ষণ পরেই শুনি আমার স্বামী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।’ যোগ করেন মানিকের স্ত্রী মুন্নী।

তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামীর কী দোষ ছিল? সে তো কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না, তাকে হত্যা করা হলো কেন? আমার দেড় বছরের শিশুটাকে আমি কী জবাব দেব? কে সান্ত্বনা দেবে আমার অবুঝ সন্তানকে? স্বামী মারা যাওয়ার ১১ দিনেও কেউ খোঁজ নেয়নি। স্বামীর উপার্জনে পরিবার চলত। আমি আমার স্বামীর হত্যাকারীদের বিচার চাই।’

সন্তান হারানোর শোকে স্তব্ধ মা নুরজাহান বেগম। শুধু চারদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছেন আর থেমে থেমে মানিকের কথা মনে পড়লে বিলাপ করছেন।

নুরজাহান বলেন, ‘মোর ছাওয়াটাক পাখির মতো গুলি করে মারছে। স্বামী বাঁচি নাই, বড় ব্যাটাটাকো হারানো। এ্যলা মোর ছাওয়ার সংসারের কি হইবে? মুই কার কাছে বিচার চাইম, মোর তো তেমন কায়ো নাই।’

মানিক মিয়ার ছোট বোন শিউলি বেগম বলেন, আমাদের বাবা মারা যাওয়ার এক যুগ হলো। তখন থেকে বাবার দায়িত্ব পালন করছিলেন আমার বড় ভাই। কিন্তু তাকে গুলি করে হত্যা করা হলো, এখন আমাদের কী হবে? আমরা কার কাছে ভাইকে হারানোর কথা বলব, কে শুনবে আমার ভাইয়ের দেড় বছরের ছোট্ট বাচ্চাটার আহাজারি? এই কষ্ট তো সহ্য করার মতো নয়।

প্রতিবেশী আব্দুস ছাত্তার (৬৫) বলেন, মানিক মিয়া কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। সে অত্যন্ত ভালো ছেলে ছিল। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। সে মারা যাওয়ার পর পাড়া-প্রতিবেশীরা তার পরিবারকে খাবার দিচ্ছে। কিন্তু তারা আর কয়দিন খাবার দেবে। এই পরিবারটির ভবিষ্যৎ কী? কেউ তো তার পরিবারকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসেনি। আমরা চাই অসহায় এই পরিবারের সদস্যদের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছু করুক, যাতে তারা ভালো থাকতে পারেন।

প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কার আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন আবু সাঈদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। মা-বাবার ৯ সন্তানের মধ্যে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সন্তান ছিল আবু সাঈদ। গত ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পার্ক মোড়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় মিছিলের সম্মুখে থেকে বুক পেতে দেওয়া আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে মারা যান। এ ঘটনায় আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে রংপুরসহ পুরো দেশজুড়ে। সেই রেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করা সরকারবিরোধী সংগঠনগুলোসহ দুষ্কৃতকারীরা ১৬, ১৮ ও ১৯ জুলাই রংপুরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও নৈরাজ্য চালিয়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Discover more from ঝিনেদা টিভি

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading