ভাড়া বৃদ্ধির অনুমতি দেয়নি রসিক, তবুও ফাঁদে জিম্মি যাত্রীরা
রংপুর মহানগরীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা চালকরা জোরপূর্বক সর্বনিম্ন ১০ টাকা ভাড়া আদায় করছেন। এতে সাধারণ যাত্রীরা চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সঙ্গে কখনো কখনো ভাড়া নিয়ে বাগবিতণ্ডার ঘটনাও ঘটছে। এ নিয়ে চালকরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ সিটি কর্পোরেশন থেকে রিকশা, অটোরিকশার লাইসেন্স ও নবায়ন ফি বাড়ানোয় তারাও ভাড়া বাড়িয়েছেন। তবে সিটি কর্পোরেশন থেকে ভাড়া বৃদ্ধির কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন সিটি মেয়র।
এদিকে অটোরিকশায় উঠলেই এখন চালককে দিতে হবে সর্বনিম্ন ১০ টাকা। রীতিমতো ভাড়া বৃদ্ধিকে জায়েজ করতে মাইকিংয়ের পাশাপাশি শ্রমিক সংগঠনগুলো থেকে অটোরিকশায় সামনে স্টিকার লাগিয়েছে। গত তিন সপ্তাহ ধরে বিষয়টি নিয়ে যাত্রী ও চালকদের মধ্যে বাগবিতণ্ডার ঘটনা ঘটছে। এমনকি হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকটি। সিটি কর্পোরেশনের অনুমোদন ছাড়া এভাবে যাত্রীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে ক্ষুব্ধ নগরবাসী।
নগরীর বাংলাদেশ ব্যাংক মোড়, মেডিকেল মোড়, সিটি বাজার, পায়রা চত্বর, জাহাজ কোম্পানি, বাস টার্মিনাল, মুলাটোল পাকারমাথা, শাপলা চত্বর, লালবাগ, প্রেসক্লাব মোড়সহ বেশকিছু এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি অটোরিকশাতে স্টিকার লাগানো হয়েছে; যেখানে লেখা- ‘সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা’। এতে বিপাকে পড়েছেন যাত্রীরা। দূরত্বভেদে লাগামহীন এমন ভাড়া নির্ধারণের কারণে প্রায়ই চালকদের সঙ্গে যাত্রীদের ঘটছে অপ্রীতিকর ঘটনা।
এ বর্ধিত ভাড়া নিয়ে প্রেসক্লাব চত্বরে অটোরিকশাচালকের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন এক ব্যক্তি। নাম প্রকাশে অনীহা জানিয়ে ওই ব্যক্তি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিটি অটোরিকশায় সর্বনিম্ন ১০ টাকা ভাড়ার স্টিকার লাগিয়ে শ্রমিক সংগঠনের নেতারা সাধারণ যাত্রীদের পকেট থেকে গত এক মাসে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। কি আজব ব্যাপার! মেয়র সাহেব কি এটা জানেন না? গ্র্যান্ড হোটেল মোড় থেকে প্রেসক্লাবের সামনে ১০ টাকা মানছেন না চালকরা। বর্তমানে দিন দিন রিকশা-অটোরিকশা চালকদের ব্যবহার খুবই বাজে হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, গ্র্যান্ড হোটেল মোড় থেকে প্রেসক্লাব চত্বরে পৌঁছাতে পাঁচ মিনিট সময় লাগে না, আগে থেকেই সর্বনিম্ন ভাড়া পাঁচ টাকা। এখন অটোচালকরা হঠাৎ করে চায় ১০ টাকা। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরাও তো কষ্টে আছি। টাকা তো আর আকাশ থেকে পড়ে না যে চাইলেই তাদের ১০ টাকা দেব। উঠলাম আর নামলাম, এক কিলোমিটার রাস্তাও হবে না, এতেই যদি ১০ টাকা দিতে হয়; তাহলে আমরা কোথায় আছি ভাবেন। সিটি কর্পোরেশনের উচিত এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা।
রংপুর টাউন হলের পাশে লক্ষ্মী সিনেমা হল সংলগ্ন সড়কে দাঁড়িয়ে কথা হয় সংস্কৃতিকর্মী সাব্বির হোসেন পরাগের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দুদিন আগে আরডিআরএস মোড় থেকে মুন্সিপাড়া পাঠশালা স্কুলের মোড়ে গেলাম। রিকশাচালক ৪০ টাকা ভাড়া চাইছিল, কেমনটা লাগে? ২০ টাকা দিয়েছি নেবে না, পরে বাধ্য হয়ে ৩০ টাকা দিলাম, তাও নাকি তার ১০ টাকা কম হয়েছে!’
জাহাজ কোম্পানি মোড়ে কথা হয় কামরুল হাসান নামের আরেকজনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে স্টেশন থেকে শাপলা চত্বরে আসতে ভাড়া ছিল পাঁচ টাকা। আর জাহাজ কোম্পানি মোড়ে আসতে দিত হত ১০ টাকা। কিন্তু আজ জাহাজ কোম্পানি মোড়ে আসার জন্য অটোতে উঠলাম। অটোচালক শাপলায় এসে বলল নামেন। ভাড়া নিল ১০ টাকা। জানতে চাইলে স্টিকার দেখিয়ে বলল সিটি কর্পোরেশন ভাড়া বাড়িয়েছে। আমি জাহাজ কোম্পানির কথা বলাতে বলল, এ গাড়ি ওদিকে যাবে না। এখানে নামেন। পরে ১০ টাকা দিয়ে নামলাম। ওখান থেকে জাহাজ কোম্পানি আসতে আবার ১০ টাকা। মোটে ১০ টাকার জায়গায় ২০ টাকা ভাড়া দেওয়া লাগলো। এভাবে মেডিকেল মোড় যেতে তো ৫০-৬০ টাকা ভাড়া দিতে হবে। ভাড়া বৃদ্ধির সুযোগে এখন অটোরিকশাচালকেরা দূরের পথে যেতে চায় না। কারণ এই শহরে তো সিটি বাস নেই। ঘুরেফিরে আমাদেরকে রিকশা কিংবা অটোরিকশায় চড়তেই হবে, এখন তো আমরা তাদের কাছে জিম্মি।
রেজাউল করিম রেজা নামের এক অটোরিকশার যাত্রীর সঙ্গে কথা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিভাগীয় শহর হিসেবে সিটি সার্ভিস চালু করা দরকার। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে দুই দফায় বাস সার্ভিস চালু হলেও তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এই সুযোগে ফায়দা লুটছে অটোরিকশাচালক ও তাদের সংগঠনগুলো। আমরা তো এখন তাদের ভাড়া বৃদ্ধির ফাঁদে আটকা পড়েছি। অন্যায়ভাবে অটোরিকশাচালকরা বেশি ভাড়া নিচ্ছেন। তাদের আইনের আওতায় আনা হোক।
মৌলি ইসলাম আরেক যাত্রী বলেন, যেসব অটোরিকশার লাইসেন্স নেই তারাও তো ভাড়া বেশি নিচ্ছে। এর প্রতিকার চাই। লাইসেন্সবিহীন অটোরিকশা প্রধান সড়কগুলোতে নিষিদ্ধ করা হোক। নয়তো বেশি ভাড়ার আশায় গ্রাম থেকে শহরে রিকশা ও অটোরিকশাচালকদের সংখ্যা বাড়তে থাকবেই।
নাট্যসংগঠক ও উন্নয়নকর্মী এস.এম আরিফ-উজ-জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিটি সার্ভিস বন্ধে অটোরিকশাচালকরা সমর্থন পেয়ে সাধারণ মানুষদের এখন জিম্মি করার সুযোগ পেয়েছে। এর প্রতিকারে সিটি বাস সার্ভিস চালু করাটা এখন সময়ের দাবি। সেটা মেয়রের উদ্যোগেই হওয়া উচিত।আরেক সংগঠক শহীদুল ইসলাম হীরা বলেন, চালকের লাইসেন্সের সঙ্গে ভাড়ার তালিকা সংযুক্ত করা জরুরি। একই সঙ্গে ভাড়ার তালিকা করে প্রতিটি অটো ও রিকশা স্ট্যান্ডে চালক ও যাত্রী সাধারণের স্বার্থে প্রদর্শন করা দরকার। এটা সম্ভব হলে ভোগান্তি অনেক অংশে কমে যাবে। তখন সিটি কর্পোরেশনের জবাবদিহিতার জায়গা তৈরি হবে।
নগরীর অন্তত ১০-১৫ অটোচালকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত লাইসেন্স ও নবায়ন ফি’র সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ায় সিটি কর্পোরেশন থেকে এ ভাড়া বৃদ্ধির অনুমতি নেওয়া হয়েছে।
পাগলাপীর এলাকার অটোরিকশাচালক সাজু মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ভাই একটা লাইসেন্স নিবার গেইলে প্রায় দুই লাখ টাকা দেওয়া লাগে। আবার লাইসেন্স রিনিউ করার খরচ ছিল ২৬০০ টাকা, এ বছর রিনিউ করির গেইলে দেওয়া লাগবে ৬০০০ টাকা। সঙ্গে চলতে ফিরতে তো সবকিছুর দাম বেশি। ভাড়া না বাড়াইলে তো আমরা চলতে পারি না। এজন্য আমরা সিটি কর্পোরেশনে আবেদন দিছি, পরে মেয়র ভাড়া বাড়ানোর অনুমতি দিছে।’
এদিকে ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে রোববার রংপুর সিটি কর্পোরেশনের সামনে বিক্ষোভ করেছে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। এতে সাধারণ যাত্রীরা সংহতি জানিয়ে অংশ নেন। তারা কর্মসূচি থেকে যাত্রী হয়রানি বন্ধ, সর্বনিম্ন ভাড়া পাঁচ টাকা নির্ধারণ এবং সিটি কর্পোরেশন থেকে ভাড়ার তালিকা প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিটি কর্পোরেশন থেকে ৫ হাজার ২৪০টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এবং ৬ হাজার ১০০টি রিকশার লাইসেন্স অনুমোদন রয়েছে। সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে এসব বাহনে যাত্রীসেবায় ভাড়ার তালিকা নির্ধারণ করা হয়নি।তিনি আরও বলেন, অটোরিকশা শ্রমিক সংগঠনের নেতারা একটি প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে এসেছিল। তারা বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে কষ্টে আছেন, পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। অটোরিকশার সর্বনিম্ন যে পাঁচ টাকা ভাড়া তা দিয়ে অনেকের পেট চলছে না। এ কারণে ভাড়া বৃদ্ধির ব্যাপারে তাদের প্রস্তাবনা তুলে ধরে আমার অনুমতি চেয়েছিল। আমি তাদেরকে পরিষদের মিটিং ছাড়া তো অনুমতি দিতে পারি না। আমি তাদেরকে (শ্রমিক নেতাদের) বলেছি পরিষদের মাসিক সভায় প্রস্তাব উঠবে। যদি পরিষদ মনে করে অনুমোদন দেওয়া দরকার তখন ভাড়া বৃদ্ধির তালিকা অনুমোদন দেওয়া হবে। তারপর এটি কার্যকরী হবে।
বর্তমানে অটো ও রিকশাচালকরা সাধারণ যাত্রীদের কাছে ভাড়া বেশি নিচ্ছেন এমন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে উল্লেখ করে মেয়র মোস্তাফিজার রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর থেকে সবকিছুর দাম বেড়ে যায়। এখানে সরকার নীরব, কোনোভাবেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কন্ট্রোল করতে পারছে না। তেমনিভাবেই অটোশ্রমিকরা বর্তমান ঊর্ধ্বগতির বাজার বিবেচনায় ভাড়া বৃদ্ধির দাবি তুলে একটা আবেদন করেন। আমি তাদের আবেদনের কপি রিসিভ করেছি কিন্তু সিদ্ধান্ত জানাইনি। তাদের আবেদন আগস্টে মাসিক সভায় উপস্থাপন করা হবে। কিন্তু তার আগেই মানুষের কাছে ভাড়া বেশি নিচ্ছে। এটি অন্যায় এবং ঠিক হয়নি।
জোরপূর্বক ভাড়া বেশি নেওয়ার একাধিক অভিযোগ পাওয়ার পর শ্রমিক নেতাদের ডেকে সাধারণ যাত্রীদের হয়রানি না করার জন্য বলা হয়েছে যোগ করেন মেয়র। তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ভাড়া বৃদ্ধির তালিকা অনুমোদন হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত বর্ধিত ভাড়া নিতে পারবে না। কারণ ভাড়া বৃদ্ধির ইতিবাচক-নেতিবাচক দুটি দিক রয়েছে। আমরা মাসিক সভায় সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবো। তারপর মূল্যতালিকা অনুমোদন দেওয়া হবে। এখন যদি আমাদের অনুমতি ছাড়া তারা বেশি ভাড়া নেয় তাহলে প্রশাসন আছে। ট্রাফিক বিভাগ চাইলে জরিমানা করতে পারে, অটোচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। সবকিছু তাদের হাতে। আমাদের এত জনবল নেই যে রাস্তায় রাস্তায় কে কত ভাড়া নিচ্ছে এটা পর্যালোচনা করা। এখানে প্রশাসনিক দায়িত্বে যারা আছেন তারা ব্যবস্থা নেবেন।