সারাদেশ

গরমে ডিমের উৎপাদন কম, সিন্ডিকেট করে বাড়ানো হয়েছে দাম

গত দশদিনে বগুড়ার হিমাগার থেকে অন্তত সাড়ে আট লাখ ডিম উদ্ধার করেছে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনিক ব্যক্তিরা। মজুদ করা এই ডিম রমজান মাসে খামারিদের কাছে কম দামে সংগ্রহ করা হয় বলে জানা গেছে। হঠাৎ করে ডিমের ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়ে এসব অভিযান চালানো হয়। তবে ডিমের দাম এখনও বাজারে হালি প্রতি ৪৬ থেকে ৪৮ টাকাই রয়েছে।

ডিমের বাজারের আগুন লাগার বিষয়ে খামারি ও ব্যবসায়ীদের দাবি, গেল মাসে দাবদাহে প্রচুর মুরগি মারা যায়। গরমে অনেক মুরগি ডিম দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এতে অনেক খামারি মুরগি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। সেখান থেকে ডিমের উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেয়।

এই ঘাটতির সুযোগ নিয়ে একটি শ্রেণি মজুদ করে ডিমের বাজার আরও অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন জেলা বিপণন বিভাগ।

বগুড়া শহরের ডিমের পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে জানা গেছে, জেলায় কাজী ফার্ম, নারিশ, নাবিল, ভিআইপি, সিপি স্থানীয় খামারি ব্যবসায়ীদের কাছে ডিম সরবরাহ করে থাকে। ডিম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম কাজী ফার্ম। তাদের হাতেই ডিমের বাজারের চাবিকাঠি।

বাজার তাদের দখলে থাকার সুবাদে কাজী ফার্মস ডিমের দর বেধে দেয়। কোথায়, কী পরিমাণ ডিম সরবরাহ হবে এসবও নির্ধারণ করে তারা।

চলতি মাসে থেকে আড়তদার ও পাইকাররাদের কাছে ৯ টাকা ৬১ পয়সা দরে প্রতি পিস ডিম বিক্রি করছে কাজী ফার্ম। সব খরচ মিলে প্রতি পিস ডিমের পাইকারি বাজারেই খরচ পড়ে ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ১১ টাকা।

এ ছাড়া খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রমজান মাসে ডিমের চাহিদা কমে প্রতি পিসের দাম আট টাকায় নেমেছিল। কম দামে কিনে ব্যবসায়ীরা ওই সময় বগুড়ার অধিকাংশ হিমাগারে ডিম মজুদ শুরু করেন। সেগুলো বাজারে ‘ভেজা ডিম’ নামে পরিচিত। অধিক মুনাফার লোভে এসব ডিম ঢাকা-চট্টগ্রামে বিক্রি করেছে ব্যবসায়ীদের একটি শ্রেণি।

শহরের রাজাবাজারের খুচরা ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান রতন জানান, কাজী ফার্ম থেকে প্রতিপিস ডিম ৯ টাকা ৬১ পয়সায় কেনা হয়। সেগুলো দোকানে নিয়ে আসতে প্রতিপিস ডিমে খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ১১ টাকা। গত তিন সপ্তাহ ধরে এমন অবস্থা। কিন্তু বাজারে নিজেদের চাহিদা মতো ডিম পাচ্ছেন না। আগে দিনে গড়ে ৪ হাজার ডিম বিক্রি হতো। সেখানে এখন ডিলাররা ডিম দিচ্ছে মাত্র ২ হাজার পিস। সাইদুর রহমানের দাবি, ডিমের দাম নিয়ে কারসাজি কোম্পানি ও ডিলার ব্যবসায়ী হাতে।

শহরের কাটনার পাড়া এলাকার ডিমের আড়তদার প্রতিষ্ঠান সেলিম এন্টারপ্রাইজের পরিচালক সেলিম রহমান বলেন, গত রমজানে ডিমের দাম কম ছিল। এ সময় তীব্র গরমেও অনেক মুরগি মারা গেছে। সে সময় ডিমের হালি ছিল ৩৬ টাকা থেকে ৩৮ টাকা। এখন বাজারে ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা হালি বিক্রি হচ্ছে। দেখা গেছে ওই সময় মাংস হিসেবে মুরগির বাজার ভালো থাকায় অনেক খামারি মুরগি বিক্রি করে দিয়েছেন। এর ফলে এখন ডিমের উৎপাদন কমে বাজারে সরবরাহ কমে গেছে।

মজুদের বিষয়ে সেলিম রহমান বলেন, রমজান মাসে মজুদ করা ডিম এখনও চলছে। এ ছাড়া কিছু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার লোভে ঢাকা-চট্টগ্রামে ডিম সরবরাহ করছেন। এটি নিয়ন্ত্রণ করলে স্থানীয় বাজার স্থিতিশীল হবে।

আড়ত ব্যবসার পাশাপাশি কাজী ফার্মসের নির্ধারিত ডিলার এই সেলিম এন্টারপ্রাইজ। এই আড়তের মালিক জহুরুল ইসলাম বলেন, বগুড়ায় সাধারণত প্রতিদিন ডিমের চাহিদা ৪ লাখ। আমাদের এই আড়তের চাহিদা দেড় লাখ পিস। সেখানে বর্তমানে আমরা কাজী ফার্মস থেকে ডিম পাচ্ছি ৫০ হাজার পিস। ডিমের ব্যবসায় আমাদের শতকরা ১০ টাকা লাভ। ডিমের সরবরাহ কমে যাওয়ায় আমাদের আয়ের পরিমাণও কমেছে।

একই এলাকার আরেক আড়তদার মেসার্স শেফা এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটর শহিদুল ইসলামও ডিমের সংকটের কথা জানালেন। আগে তার আড়তে প্রতিদিন ২ লাখের বেশি ডিম বিক্রি হতো। এখন ৫০ থেকে ৭০ হাজার পিস ডিম বিক্রি হচ্ছে।

শহিদুল ইসলাম বলেন, ডিমই সংগ্রহ করতে পারছি না। এখন শুধু কাজী ফার্মের ডিম পাচ্ছি। গত এক মাসে নাবিল ফার্মের কোনো ডিমের হিসেব নেই আমার কাছে।

ডিমের বাজার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ বড় কোম্পানির হাতে দাবি করে শহিদুল ইসলাম জানান, ডিমের সংকট থাকবে না। মুনাফার লোভে কিছু ব্যবসায়ী বগুড়ার ডিম ক্রয় করে ঢাকা-চট্টগ্রামে নিয়ে যাচ্ছেন। উত্তরবঙ্গের ডিম যদি ওই দিকে না যায় তাহলে বগুড়ার বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে।

খামারিরা বলছেন, গত মাস পর্যন্ত তারা ডিম উৎপাদন করে লোকসানে ছিলেন। লোকসান থেকে বাঁচতে অনেকে মুরগি বিক্রি করে দেন। সদরের এরুলিয়ার এসএস পোল্ট্রি ফার্মের মালিক শামসুল আলম জানান, মুরগির বয়স হয়ে যাওয়ায় তিনি ঈদের আগে ৭ হাজার মুরগি বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন তার খামারে রয়েছে ১৩ হাজারের বেশি মুরগি। এর মধ্যে ৬ হাজার মুরগি ডিম দিচ্ছে। যা থেকে গড়ে প্রতিদিন ৫ হাজারের মতো ডিম সংগ্রহ করা যায়। বাকী মুরগি আগামী দেড় থেকে ২ মাসের মধ্যে ডিম দেওয়া শুরু করবে।

এই খামারি বলেন, সব খরচ বাদ দিয়ে একটা ডিম উৎপাদনে বর্তমানে ১০ টাকার মতো খরচ পরে। স্থানীয় বাজারে ১০ টাকা ৯০ পয়সা থেকে ১১ টাকা পিস দরে ডিম বিক্রি করে থাকি।

শিবগঞ্জের রহবল এলাকার খামারি ফরহাদ হোসেন পলাশ আশঙ্কা করেন, কয়েক বছর পর তাদের মতো প্রান্তিক খামারি থাকবে না দেশে। কারণ একটি জেলার ডিমের যে চাহিদা তা বড় কোম্পানির একটি শেডেই উৎপাদন হচ্ছে। সেখানে প্রান্তিক খামারিরা ডিম উৎপাদন করতে গিয়ে টিকতে পারছেন না। এবারেও অধিক গরমে তাকে বাধ্য হয়ে মুরগি বিক্রি করতে হয়েছে। এখন শেডে মুরগির বাচ্চা কিনতে গিয়ে দেখেন দাম বাড়তি।

পলাশ বলেন, রমজানে আমরা প্রায় ২ টাকা লোকসান দিয়ে ডিম বিক্রি করেছি। আর এখন ব্যবসায়ীদের একটি শ্রেণি প্রতি ডিমে প্রায় আড়াই টাকা লাভ করছে। তখন তো আপনারা কেউ আমাদের কাছে জানতে চাননি কীভাবে চলছি। এখন ডিমের দাম বেশি এ জন্য আপনারা খোঁজ করছেন। ওই সময় ডিমের চাহিদা না থাকায় অনেক ব্যবসায়ীরা কম দামে কিনে মজুদ করেছেন। খামারিদের পক্ষে মজুদ করা সম্ভব না। তবে ডিম উৎপাদনকারীদের জন্য আলাদা হিমাগার করলে খামারিরা বছরের ‘ডালসিজনে’ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। অসাধুরা ডিমের অধিক মুনাফা করতে পারবেন না।

ডিমের সরবরাহে ঘাটতি আছে কিনা এমন বিষয়ে কাজী ফার্মের বগুড়ার অফিসের ম্যানেজার মাহবুব বলেন, ঘাটতির বিষয়ে আমাদের জানা নেই। আমরা সরকার নির্ধারিত রেট ৯ টাকা ৬১ পয়সা দর ফলো করে ডিম বিক্রি করি। বগুড়ায় প্রতিদিন ৩ লাখ পিস ডিম বিক্রি করে কাজী ফার্ম।

অবশ্য বগুড়া জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় ডিমের ঘাটতি হওয়ার কোনো কারণ নেই। জেলায় ৩৭০টি ডিম উৎপাদনকারী মুরগির খামার রয়েছে। প্রতিদিন ডিম উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১০ লাখ ৬৪ হাজার ১৯টি। সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ২২ লাখ ১৮ হাজার ৬০০টি ডিম। গত মাসে বয়ে যাওয়া দাবদাহে মুরগির মৃত্যুর কোনো তথ্য নেই দপ্তরের কাছে।

বগুড়া জেলা সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তার কার্যালয় বলছে, জেলায় বর্তমানে প্রতিদিন ডিমের চাহিদা প্রায় ৪ লাখ। এই ডিমের সব বগুড়ায় উৎপাদন হয় না। লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা থেকে ডিম আসে।

ডিমের বাজারের তৃতীয় একটি পক্ষ কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে বিষয়টি স্বীকার করছেন বগুড়ার সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মমতা হক। তিনি জানান, রমজান মাসে ডিমের সরবরাহ বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা ১৫ দিনের জন্য হিমাগারে ডিম সংরক্ষণ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কারণ ওই সময় বিক্রি না হলে ডিমগুলো পচে যেতে পারে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তৃতীয় একটি শ্রেণি ডিম নিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে।

ডিমের বাজারের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে মমতা হক বলেন, মূল ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে কাজী ফার্ম। লোকাল যে-সকল খামারি আছে তারা হয়ত কিছুটা কম দামেও দিতে চায়। কিন্তু কাজী ফার্ম সকালে একটা দাম নির্ধারণ করে দেয়। ওরা বলে বিডিং, কিন্তু বিডিং বলতে যেটা বোঝায় সেটা তারা ফলো করে না।  কাজী ফার্ম, সিপি বাংলাদেশ লিমিটেড এরাই নির্ধারণ করে কত দাম, কাকে কতগুলো ডিম দেবে। দেখা যাচ্ছে অনেক আড়তদার আছে যাদের কেনার ক্ষমতা অনেক কিন্তু তাকে দিচ্ছে না।

প্রসঙ্গত, গত ১৫ মে বগুড়ার কাহালুর আফরিন কোল্ড স্টোরেজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৫ লাখ ডিম অবৈধ মজুত পায় উপজেলা প্রশাসন। পরে প্রতিষ্ঠানটিকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এরপর ১৮ মে শনিবার বগুড়া সদরের নুনগোলা ইউনিয়নের ঘোড়াধাপ এলাকার সাথী হিমাগার ইউনিট-২ এবং শাজাহানপুর উপজেলার ফাতেমা সাইদুর নামের দুটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করে প্রশাসন প্রায় এক লাখ ৪০ হাজারের মতো ডিম পায়। এর কয়েকদিন পর ২২ মে সদরের কাফেলা কোল্ড স্টোরেজে উদ্ধার হয় ২ লাখ পিস ডিম।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Discover more from ঝিনেদা টিভি

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading