জাতীয়

কারামুক্ত হয়ে ফের শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রে জড়ান শিশু সাহিত্যিক টিপু

সাত বছর জেল খেটেও বদলায়নি স্বভাব. নাম টিআই এম ফখরুজ্জামান, তবে পরিচিত টিপু কিবরিয়া হিসেবে। অনেক আগে সেবা প্রকাশনী পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। শিশুসাহিত্যিক ও আলোকচিত্রী হিসেবে কামিয়েছেন নাম-যশ। বেশ কয়েকটি ছড়ার বই ছাড়াও ‘হরর ক্লাব’ নামে শিশুদের জন্য রচিত সিরিজ বই আছে তার।

তবে এসবের আড়ালে তিনি ভয়ংকর ও বিকৃত মানসিকতার। বাংলাদেশে বসে তিনি আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি অপরাধী চক্রের সঙ্গে যুক্ত। ভয়ংকর এ অপরাধে জড়িত থাকার কারণে অনেক দেশে তিনি শিশু পর্নোগ্রাফির অপরাধী হিসেবে তালিকাভুক্ত।

২০১৪ সালের জুনে শিশুদের পর্নোগ্রাফি তৈরি ও পাচারের অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ইন্টারপোলের তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে প্রথম গ্রেপ্তার হন টিপু কিবরিয়া। তখন ওই ঘটনা নিয়ে বেশ তোলপাড় হয়। দীর্ঘ ছয় বছর কারাগারে থাকার পর ২০২১ সালে কারামুক্ত হন তিনি। এরপরও স্বভাব বদলায়নি টিপু কিবরিয়ার। নজরদারিতে থাকা টিপু কিবরিয়াকে আবার গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)।

মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকা থেকে কামরুল ইসলাম নামের এক সহযোগীসহ তাকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের একটি টিম।

সিটিটিসি বলছে, টিপু কিবরিয়া আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রের বাংলাদেশের মূলহোতা। তার বাসা থেকে ক্যামেরা পিসি, ক্লাউড স্টোরেজ থেকে প্রায় ২৫ হাজারের মতো শিশু পর্নোগ্রাফির উদ্দেশ্যে তোলা ছবি ও এক হাজারের মতো ভিডিও কনটেন্ট পাওয়া গেছে। শিশু পর্নোগ্রাফির ভুক্তভোগী শিশুরা সবাই ছিন্নমূল পথশিশু (ছেলে)।

বুধবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।

তিনি বলেন, ঢাকা শহরের গুলিস্তান, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানের ও দেশের বিভিন্ন স্থানের ছিন্নমূল পথশিশুদের পর্নোগ্রাফির কাজে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে যুক্ত করতেন টিপু কিবরিয়া। সামান্য অর্থের প্রলোভনে বাসায় নিয়ে গিয়ে অশ্লীল ও গোপনাঙ্গের ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করে আন্তর্জাতিক যে ক্লায়েন্ট আছে, তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। বিদেশি ক্লায়েন্টদের চাহিদা মাফিক বন-জঙ্গলে ছিন্নমূল পথশিশুদের নিয়ে গিয়ে পর্নোগ্রাফির জন্য ভিডিও করতেন। তার বাসায় পর্নোগ্রাফির জন্য ভিডিও এডিটিং প্যানেল আছে। সেখানে তিনি এডিটিং করে বিদেশি ক্লায়েন্টদের মেইলে পাঠাতেন। যা পরে বিভিন্ন পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইটে আপলোড করা হতো।

আগে তিনি ইমেইলের মাধ্যমে পাঠাতেন। পরবর্তী সময়ে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে নতুন মেগা ও টোটেনা নামক দুটি এনক্রিপটেট অ্যাপসের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক গ্রাহকদের কাছে পর্নোগ্রাফির কনটেন্টগুলো পাঠাতে শুরু করেন। আমরা তার কাছ থেকে যে ডিভাইস উদ্ধার করেছি, তাতে দেখা গেছে, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানিসহ আরও অনেক দেশের গ্রাহকদের তালিকা পাওয়া গেছে। যাদের কাছে তিনি বিকৃত ও অশ্লীল পর্নোগ্রাফির ভিডিও ছবি পাঠিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন।

তার কাছ থেকে উদ্ধার করা সব ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস থেকে আমরা এখন পর্যন্ত ২৫ হাজার অশ্লীল ছবি ও ১০০০ ভিডিও পেয়েছি। ফরেনসিক বা ফিল্টারিংয়ের কাজ শেষ হলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে।

এক প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান বলেন, মাত্র ৫০০ কিংবা হাজার টাকার প্রলোভনে টিপু কিবরিয়া ছিন্নমূল পথশিশুদের নিয়ে আসতেন। তার চক্রে কামরুল ছাড়াও আরও অনেক সহযোগীর নাম আমরা পেয়েছি। আমরা দুজনকে গ্রেপ্তারের সময় একজন ভুক্তভোগী শিশুকে উদ্ধারের পর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছি।

শিশুদের পর্ণ ভিডিও বিদেশিদের কাছে পাঠিয়ে কী পরিমাণ টাকা তিনি পেতেন এবং কীভাবে পেতেন? জানতে চাইলে ডিএমপির এ অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, অর্থের লেনদেন হতো ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন ও কিছু এমএফএসের মাধ্যমে। ৩/৪টি ছোট ছোট ভিডিও পাঠালেই তিনি পেতেন হাজার ডলার। সর্বশেষ এক বিদেশি গ্রাহককে তিনি তিনটি পর্নোগ্রাফির ভিডিও পাঠিয়ে এক হাজার ডলার পেয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তার এজেন্ট। এ রকম আমরা বেশ কয়েকজন এজেন্টকে শনাক্ত করেছি। পাশাপাশি ২৫/৩০ জনের মতো ভুক্তভোগী শিশুকে শনাক্ত করা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা সবাই ছেলে। তাদের সংখ্যা অনেক।

সিটিটিসি জানায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষে কিশোর কবিতা, গল্প ও ছড়া ছাড়াও নব্বইয়ের দশকে তিনি ‘হরর ক্লাব’ নামে কিশোরদের জন্য সিরিজ গল্প লিখে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সেবা প্রকাশনী থেকে তার এসব লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হত। এক সময়কার তিনি খুবই জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক। শিশুসাহিত্য লেখার সময় তিনি অনেক শিশুর সঙ্গে মিশেছেন। ২০০৫ সালের দিকে তিনি শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৪ সালে গ্রেপ্তার হয়ে ২০২১ সালে কারাগার থেকে বের হন। এরপর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ‘একশো এক’ নামক একটি কবিতার বই প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তিনি সাহিত্য চর্চার আড়ালে পুনরায় শিশু পর্নোগ্রাফির সেই পুরোনো অপকর্ম শুরু করেন।

এর আগে, ২০১৪ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর সিআইডি কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, টিপু কিবরিয়া টাকার বিনিময়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের অন্তত আটটি আন্তর্জাতিক পর্নোগ্রাফি চক্রের কাছে বাংলাদেশি শিশুদের ব্যবহার করে পর্নো ভিডিও ও স্থিরচিত্র পাচার করে আসছিলেন।

ওই সময় ইন্টারপোলের বরাত দিয়ে সিআইডি জানিয়েছিল, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পর্নো ব্যবসায়ী চক্রের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই জড়িত টিপু কিবরিয়া। ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের শিশুদের পর্নোগ্রাফি বিদেশে পাচার হচ্ছিল। দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগটির বিষয়ে নজরদারি করে টিপুর চেহারা শনাক্ত করে ইন্টারপোল। ওই সময় টিপুর বাসায় অভিযান চালিয়ে শতাধিক পর্নো সিডি, লুব্রিকেটিং জেল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্টিল ও ভিডিও ক্যামেরা উদ্ধার করা হয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Discover more from ঝিনেদা টিভি

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading