জাতীয়

‘বাংলা কইতে পারি, অক্ষর কেমন জানি না’

রক্তের বিনিময়ে এসেছে আমাদের ভাষার স্বীকৃতি। ভাষার জন্য সেই ত্যাগ পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। ২১শে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কিন্তু যে দেশের শহীদদের রক্তের বিনিময়ে এল মাতৃভাষার স্বীকৃতি, সেই দেশে বসবাসকারী অনেক মানুষ এখনো চেনে না অ আ ক খ। বাংলা বর্ণমালা তাদের কাছে দূরদেশের কোনো অচিন পাখির মতো। আশপাশে অনেকে সে পাখির কথা বলে, কিন্তু তারা কোনোদিন দেখেনি!

তাসনুর বেগম। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়লেও স্বীকার করেন এখনো ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেননি সংসার। ইতোমধ্যে সন্তান-সন্ততি আর নাতি-নাতনির ১০ জনের পরিবার। থাকেন নদীর জলে ভাসমান ছোট্ট নৌকায়। বরিশাল সদর উপজেলার লাহারহাট লঞ্চঘাটের ঠিক বিপরীতে জেগে ওঠা চরে লগি ফেলে নৌকায় বসবাস তাদের। জীবনের শুরু থেকে এখানেই রয়েছেন। কম করে হলেও ৩৫ বছর।

উত্তাল কালাবদর নদীর সঙ্গে দারুণ সখ্যতা তাসনুরের পরিবারের। কিন্তু এই দশজনের একজনেরও বাংলা বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয় নেই। এমনকি সংখ্যা গুনতেও পারেন না তাদের কেউ। তাসনুরের পরিবারের সর্বোচ্চ যিনি শিক্ষিত তিনি কুড়ি (২০) পর্যন্ত গুনতে পারেন।

তাসনুর বলেন, ‘ভাইগো বাংলা কইতে পারি। অক্ষর কেমন জানি না। কোন অক্ষরের মানে কী হেইসব আমাগো কেউ শিখায় নাই।’

স্থানীয় ট্রলার মাঝি সুমন পহলান বলেন, লাহারহাটের মান্তা গোষ্ঠীর কেউ লেখাপড়া জানে না। ওরা নদীতে মাছ ধরে লাহারহাটে এনে বিক্রি করে। বিক্রি শেষে ক্রেতা যে টাকা দেন তা নিয়ে স্থানীয় দোকানদারদের দিয়ে গুনে নেয়। অনেক দিন আমাকেও দিয়েছে গুনে দিতে।

কেবল তাসনুরের পরিবার নয়, লাহারহাটের কালাবদর নদীতে বসবাস করা ৪০টি পরিবারের দুই শতাধিক মানুষ বাংলা বর্ণমালা সর্ম্পকে ধারণা রাখেন না।

একইভাবে বাবুগঞ্জ উপজেলার মীরগঞ্জ ফেরিঘাট, বানারীপাড়া, উজিরপুর, বাকেরগঞ্জ, ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর তীরে এবং ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার জিরো পয়েন্ট এলাকায় অবস্থানকারী হাজারের বেশি বেদে সম্প্রদায়ের লোকেরা কেউই বাংলা বর্ণমালা চেনেন না।

নলছিটি জিরো পয়েন্ট এলাকায় অবস্থানকারী দলের সর্দার রেজাউল করিম বলেন, বেদে সম্প্রদায় মূলত যাযাবর। আমাদের নিজস্ব কোনো ঘরবাড়ি নেই। এখন অনেকে অবশ্য বিভিন্ন এলাকায় ভোটার হয়ে কোথাও কোথাও ঘরবাড়ি গড়ে তুলেছেন। ঘরবাড়ি গড়লেও আমাদের মধ্যে এক শতাংশ লোকও শিক্ষিত পাবেন না। শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ নেই। আমরা পুরুষেরা দিন হলে বিভিন্ন বাজারে যাই, সাপ খেলা দেখাই। গাওয়ালের (গ্রামে) পুকুরে স্বর্ণ খুঁজি। অনেকে বনের গাছের গুণাগুণ প্রচার করে ওষুধ বিক্রি করে। আমাদের সম্প্রদায়ের নারীরা গ্রামে গ্রামে হেঁটে সিংগা লাগায়, টোটকা চিকিৎসা দেয়।

লাহারহাটের মান্তা সম্প্রদায়ের রোজিনা বেগম বলেন, সন্তান জন্ম হওয়ার পর কোমরে দড়ি বেঁধে নৌকার সঙ্গে আটকে রাখি, যেন নবজাতক নদীতে না পড়ে যায়। ৮-১০ বছর পর্যন্ত এভাবে চলে। তারপর দড়িতে বাঁধা জীবন মুক্তি পায়। আমাদের ও সন্তানদের লেখাপড়ার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের জন্য সরকার কোনো উদ্যোগও নেয় না। আমরা যেহেতু নদীতে-বন্দরে ভেসে বেড়াই এজন্য কেউ স্কুলে ছেলেমেয়ে ভর্তি করাই না।

শাহ আলম নামে একজন বলেন, বেদে বা মান্তা সবই এক। আমরা মারা গেলে আগে নদীতে মরদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হতো। এখন হয়তো কারো কাছে অনুরোধ করে তার জমিতে দাফন করা হয়।

ভাসমান এই জনগোষ্ঠীর ঠিক কতজন লোক বরিশাল বিভাগে রয়েছে সে সর্ম্পকে স্থানীয় প্রশাসনের দপ্তরে যোগাযোগ করে কোনো তথ্য জানা যায়নি।

বরিশালের গবেষক সুশান্ত ঘোষ বলেন, মাতৃপ্রধান বেদে সম্প্রদায়ের লোকদের শিক্ষার হার একেবারেই কম। অনেকে টাকা গুনতেও পারেন না। টাকার হিসাব মেলাতে পারেন না। যে কারণে তাদের জীবনের হিসাব মেলে না। শিক্ষার জ্ঞান না থাকায় তারা প্রায়ই লেনদেনে ন্যায্যতা পায় না। তারা যে অন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন এটিও তারা বুঝতে পারেন না। দেশের টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়ন করতে হলে এই অনগ্রসর গোষ্ঠীকে শিক্ষার আলোয় নিয়ে আসতে হবে।

তিনি বলেন, বেদে সম্প্রদায়ের মানুষ ৮টি পেশার সঙ্গে জড়িত। কেউ মাছ ধরে, কেউ স্থলে কবিরাজিসহ নানান পেশায় জড়িত। ১৬৩৮ সালের দিকে আরাকান রাজ্য থেকে বেদেরা বাংলায় আসে। বেদেরা এখন বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গেছে। সুতরাং এই গোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য, শিক্ষিত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Discover more from ঝিনেদা টিভি

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading