যে ৬টি কাজ করলে বুঝবেন আপনার শিশুর ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বেশি
অভিভাবক হিসেবে আমরা চাই শিশু যেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়, যেকোনো কাজে সফলতা অর্জন করে, অন্যের সঙ্গে তার সম্পর্কগুলো যেন সুখময় হয় এবং শিশুর জীবনের যেন একটা ‘উদ্দেশ্য’ থাকে। দুই শতাধিক শিশুর আচার-আচরণের ওপর গবেষণা করে সচেতন অভিভাবকত্ব–বিষয়ক মার্কিন গবেষক রিম রাউডা জানতে পেরেছেন, যেসব শিশুর ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বেশি, তারা বিশেষ ৬টি কাজ করে। কী সেই ৬টি কাজ? কীভাবে আপনার শিশুকে সেসব শেখাবেন? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
সবার আগে জেনে রাখুন ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স কী?
১. তারা ইশারা-ইঙ্গিত ভালো বুঝতে পারে:
ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বেশি এমন শিশুরা অন্যের শরীরী ভাষা বা মুখের অভিব্যক্তি দেখে তার অনুভূতি খুব ভালো করে বুঝতে পারে। তারা বলতে পারে, ‘মা, আমার বন্ধু রাতুল আজ খুব চুপচাপ ছিল। ও খেলতে চায় কি না, তা যখন জানতে চাইলাম, ও বলল, না, খেলব না। মনে হয়, কোনো কারণে রাতুলের মনটা আজ বেশ খারাপ ছিল।’
যেভাবে এই দক্ষতা গড়ে তুলবেন:
শিশুর সঙ্গে নিয়মিত কথোপকথন চালান। দিনটি তার কেমন ছিল, সে ব্যাপারে জানতে চান। সারা দিন যাদের সঙ্গে সে মেলামেশা করে, তাদের আবেগকে সে কীভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে, তা জানতে চান। এভাবে কথোপকথনের চর্চা করলে অন্যের আবেগ-অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা এবং নিজের আত্মবিশ্বাস—উভয়ই বৃদ্ধি পাবে। শিশুকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, ‘আজ ক্লাসে তোমার বন্ধুদের মধ্যে কে কেমন মুডে ছিল?’ এ ধরনের প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শিশুর মধ্যে দক্ষতাটি গড়ে উঠবে।
২. তারা সহানুভূতি দেখায়:
ইমোশমাল ইন্টেলিজেন্স বেশি এমন শিশুরা যে কেবল অপরের আবেগ-অনুভূতি বুঝতে পারে, তা নয়। বরং অন্যের প্রতি দায়িত্ববোধ, উদ্বেগ ও সহানুভূতিও দেখায়, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। যেমন ধরুন, খেলার সময় আপনার শিশুর কোনো এক বন্ধু খেলায় জিততে না পারার কারণে মন খারাপ করে বসে আছে। তখন আপনার শিশু সেটি খেয়াল করে সেই বন্ধুটির কাছে গিয়ে বলে, ‘তুমি তো অনেক ভালো খেলেছ! এসো, আমরা নাহয় অন্য আরেকটা খেলা খেলি?’ শিশুর এ ধরনের মানসিকতা বোঝায় সে অন্যের ব্যাপারে বেশ সহানুভূতিশীল।
যেভাবে এই দক্ষতা গড়ে তুলবেন:
শিশুর মধ্যে সহানুভূতিবোধ তৈরি করতে অভিভাবকদের জন্যে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো শিশুর সামনে নিজেরাই সেসবের চর্চা করা। আপনার পরিবারের সদস্য, বন্ধু বা প্রতিবেশীর যেকোনো সমস্যায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। আপনার দেখাদেখি শিশুও তা শিখবে।
৩. তারা আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে:
ইমোশনালি ইন্টেলিজেন্ট শিশুরা নিজেদের আবেগ-অনুভূতি খুব ভালো করেই প্রকাশ করতে পারে। শিশু বলতে পারে, ‘ধুর! পাজলটা মেলাতেই পারলাম না! খুব খারাপ লাগছে।’ অথবা বলতে পারে, ‘বন্ধুর ভেঙে যাওয়া খেলনাটা জোড়া লাগিয়ে দিয়েছি বলে আমার খুব ভালো লাগছে।’ এসব কথাই প্রমাণ করে, আপনার শিশু নিজের অনুভূতিকে ভালোভাবেই স্বীকৃতি দেয়।
যেভাবে এই দক্ষতা গড়ে তুলবেন:
শিশুর সামনে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করুন। সেটা যতই মামুলি অনুভূতিই হোক না কেন, প্রকাশ করুন। যেমন বলতে পারেন, ‘চাবিটা খুঁজেই পাচ্ছি না! এখন এই ড্রয়ার খুলব কীভাবে?’ কিংবা ‘এত কাজ এত কাজ! কীভাবে যে শেষ করব!’ এভাবে শিশুর সামনে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারলে শিশুও নিজের অনুভূতি প্রকাশ করাকে স্বাভাবিক বলেই শিখবে।
৪. তারা মানিয়ে নিতে পারে:
পূর্বনির্ধারিত কোনো কিছুর পরিবর্তন সহজভাবে নেওয়া, কোনো দুঃসংবাদ ঠান্ডা মাথায় গ্রহণ করা—এসবই শিশুর মানসিক পরিপক্বতার প্রমাণ। ধরুন, বৃষ্টির কারণে পূর্বনির্ধারিত ঘুরতে যাওয়ার আয়োজন বাতিল করতে হলো। তখন আপনার শিশু মন খারাপ না করে ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করলে বোঝা যায় সে সহজে মানিয়ে নিতে পারছে। এ ক্ষেত্রে শিশু বলতে পারে, ‘ওহ্, বাইরে বৃষ্টি, তাহলে চলো ঘরেই ক্যারম বোর্ড খেলি!’
যেভাবে এই দক্ষতা গড়ে তুলবেন:
এই চর্চাও পরিবারের ভেতর থেকে শুরু হতে হবে। যেকোনো কিছুতে আগে নিজে মাথা ঠান্ডা রাখুন। ধীরেসুস্থে নিজের অনুভূতি বা মতামত প্রকাশ করুন। আপনাকে দেখেই শিশু সেসব অনুকরণ করবে। সেই সঙ্গে সমস্যা সমাধানে আপনার শিশুকেও আমন্ত্রণ জানান। শিশুর কাছে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, ‘তাহলে সমস্যাটি আমরা কীভাবে সমাধান করতে পারি?’
৫. তারা শ্রোতা হিসেবেও ভালো হয়:
ইমোশনালি ইন্টেলিজেন্ট শিশুরা খুব সূক্ষ্ম ইঙ্গিতও বুঝতে পারে, যেসব অন্যরা সহজে পারে না। আপনি যখন সারা দিন ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার গল্প শিশুর সামনে করবেন, এ ধরনের শিশুরা তা শুধুই শুনবে না, সঙ্গে আপনার কথায় মিশে থাকা আবেগও ধরতে পারবে। আপনাকে পরে সে বিষয়ে প্রশ্ন করবে এবং আরও জানতে কৌতূহল দেখাবে।
যেভাবে এই দক্ষতা গড়ে তুলবেন:
আপনার শিশু যখন আপনাকে কোনো গল্প বলবে, তখন পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে শুনুন। তখন অন্য কোনো কাজ করবেন না, শিশুর চোখে চোখ রেখে গল্পটা শুনবেন। এককথায় শিশুকে বোঝাবেন, সে যা বলছে, তা আপনি ভালো করেই শুনছেন।
৬. তারা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে:
ইমোশনালি ইন্টেলিজেন্ট শিশুরা বড় বড় আবেগময় ঘটনাবলি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, জটিল পরিস্থিতিতে শান্ত থেকে সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মনে করুন, আপনার শিশু বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে প্রথম দফায় হেরে বসলেও হতাশায় ভেঙে না পড়ে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এটা শিশুর আত্মনিয়ন্ত্রণের একটা উদাহরণ। এ ধরনের শিশুরা হতাশ হলেও মাথা ঠান্ডা রাখে এবং সামনে এগিয়ে যায়।
যেভাবে এই দক্ষতা গড়ে তুলবেন:
আপনি নিজে বিরূপ পরিস্থিতিতে উত্তেজিত না হলে, চিৎকার না করলে আপনার শিশুও আপনাকে দেখে অনুপ্রাণিত হবে। পাশাপাশি শিশুকে ‘পজ অ্যান্ড ব্রেদ’ পদ্ধতি শেখাতে পারেন। কঠিন সময়ে বিরতি নিয়ে বুক ভরে শ্বাস নেওয়া বা ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গোণাকে ‘পজ অ্যান্ড ব্রেদ’ পদ্ধতি বলে। নিজেও এর চর্চা করুন, শিশুকেও শেখান।