আন্তর্জাতিকরাজনীতিসর্বশেষ

ভূ-রাজনৈতিক জটিল সমীকরণের মুখে বাংলাদেশ

কয়েক সপ্তাহ ধরে অনেক বেশি অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে মিয়ানমার। দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সংঘর্ষের ঘটনা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। বলা যেতে পারে সেখানে গৃহযুদ্ধ চলছে।

দেশটির এ পরিস্থিতি নতুন করে চিন্তায় ফেলেছে বাংলাদেশকে। আগে থেকে আশ্রয় নেওয়া ১০ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে ইতোমধ্যে কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বারবার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি। এ অবস্থায় আবারও যদি রোহিঙ্গাদের ঢল নামে কিংবা সেখানকার অন্য জনগোষ্ঠী সীমান্ত অতিক্রম করে তাহলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে।

গত তিনদিনে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কাছে কয়েকটি সেনা ঘাঁটি এবং ৬২ জন সৈন্য হারিয়েছে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী। সশস্ত্র দুই বিদ্রোহী গোষ্ঠী পিপলস ডেমোক্রেটিক ফোর্স (পিডিএফ) এবং এথনিক আর্মড অর্গানাইজেশন (ইআও) সংঘাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আছে রাখাইনের আরাকান আর্মিও।

এদিকে সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টারশেলের আঘাতে হোসনে আরা (৪৫) নামে এক বাংলাদেশি নারী এবং নবী হোসেন নামে এক রোহিঙ্গা (৬৫) নিহত হয়েছেন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম বলেন, দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বর্ডার গার্ড পুলিশ-বিজিপি) সর্বমোট ১১৩ জন সদস্য অস্ত্রসহ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাখাইনসহ মিয়ানমারের নানা অংশে সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের চলমান লড়াই বাংলাদেশের নিরাপত্তা এবং বঙ্গোপসাগরে প্রভাব ফেলবে। আর রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির অব্যাহত লড়াইয়ে রোহিঙ্গা সংকট আরও প্রকট করবে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা, আরাকান থেকে আরও মানুষ আসবে এবং সেটা আগের মতো রোহিঙ্গারা নাও হতে পারে। আরও জটিল হবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের গা বাঁচিয়ে চলার দিন শেষ। কাল বিলম্ব না করে সরকারকে এখনই করণীয় নির্ধারণ করে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার জান্তা সরকারের সঙ্গে গত ৫-৬ বছরের যত যোগাযোগ, আলাপ-আলোচনা হয়েছে তার ফলাফল শূন্য। কাজেই নতুন কেউ যদি মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসে এরচেয়ে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনাই কম। বর্তমান মিয়ানমার কেন্দ্রীয় সরকারের সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আমি মনে করি না যে সামরিক সরকার পরাজিত হবে আর রাতারাতি বিদ্রোহীরা ক্ষমতায় যেতে পারবে। তবে বিদ্রোহীরা বিভিন্ন অঞ্চল দখলে নিচ্ছে। সেখানে তারা আধিপত্য বজায় রাখার সব ধরনের চেষ্টা করবে।

মিয়ানমারের এমন অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশের আসলে কী করা উচিত? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বড় সমস্যা তো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন করা। মিয়ানমারে ফেরাতে বাংলাদেশ বরাবর মিয়ানমার জান্তা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসছে। আমাদের উচিত অফিসিয়ালি মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা। বর্তমান পরিস্থিতিতে আন-অফিসিয়ালি মিয়ানমারের জাতীয় ঐকমত্যের সরকার (এনইউজি) এবং আরাকান আর্মিসহ নানা পক্ষের সঙ্গে যেকোনো স্তরে যোগাযোগের বিষয়টি বাংলাদেশের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা যে অঞ্চলগুলো ছেড়ে এসেছিল সেখানেই মূলত বিদ্রোহ সংঘর্ষ বেশি হচ্ছে। এমন অবস্থার মধ্যে নতুন করে রোহিঙ্গা বা বাস্তুচ্যূতদের ঢল নামার সম্ভাবনা দেখছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। শক্ত অবস্থান নিতে হবে। কারণ অতীতে আমাদের দুর্দশার মধ্যে রোহিঙ্গা ঢলের সময় পুরো বিশ্ব শুধু তাকিয়ে দেখেছে। কোনো ধরনের সাহায্য-সহায়তা করেনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে। আমরা যথেষ্ট নিয়েছি। আর নেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের আর বাহবা পাওয়ার প্রয়োজন নেই। নতুন করে কাউকে আশ্রয় দেওয়ার মতো অবস্থাও আমাদের নেই।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতিতে বাণিজ্যিক সংকট বাড়াবে। যদি বিদ্রোহীরা সেখানে জিতে যায় তাহলে তাদের সঙ্গে আমাদের নতুন করে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদেও সমস্যা হতে পারে। কারণ তাদের সঙ্গে তো বোঝাপড়ায় আসতে হবে। আমাদের দেশে ১০ লাখের মতো শরণার্থী আশ্রিত। আরও শরণার্থী আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সেটা সৈন্য আসুক আর উদ্বাস্তু হয়ে আসুক। সেটা তো সংকট। তৃতীয়ত, আশ্রিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠছে। কারণ আগে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে জান্তা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করত। এখন তো বিদ্রোহী গোষ্ঠী বা আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এছাড়া সীমান্ত এলাকাও বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যে দুজন মারা গেছে। ভূরাজনৈতিক প্রভাবও তো থাকবে।

এমন পরিস্থিতিতে সরকারের উদ্যোগ বা পদক্ষেপ কতটা দৃশ্যমান বা শক্ত? জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার তো ডিফেনসিভ। ছোট দেশ হিসেবে কি ই-বা করার আছে! ছোট দেশ চট করে সাহসী হতেও পারে না। এটা তো স্পষ্ট যে, আমরা কয়েক বছরের চেষ্টায় রোহিঙ্গাদের ফেরাতে পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। বর্তমান পরিস্থিতি তো সেটি আরও জটিল করল। এটা তো সরকারের জন্য উদ্বেগের। এমন অবস্থার মধ্যেই সরকারকেই করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। এটা তো ক্রাইসিস। এই ক্রাইসিস থেকে কীভাবে সুযোগ বের করা যায় সেটা ঠিক করতে হবে।

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গর্ভেনেন্সের (এসআইপিজি) জ্যেষ্ঠ ফেলো নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মিয়ানমারে বর্তমানে যা ঘটছে সীমান্তে এর প্রভাব পড়ছে। তাতে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। রাখাইনে যে ভয়াবহ লড়াই শুরু হয়েছে, যা বাংলাদেশের সীমান্তে এসে পড়েছে। এখন অপেক্ষায় থাকা রোহিঙ্গারা আবার সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে আসার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। রোহিঙ্গারা সীমান্তের কাছে চলে এলে আমাদের সামনে বিকল্প কী? অন্যদিকে আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছে। সব মিলিয়ে আমরা খুবই নড়বড়ে এক নিরাপত্তা পরিস্থিতির সামনে রয়েছি। ভূ-রাজনৈতিকভাবে ঝড়ের কেন্দ্রে আছি। ভবিষ্যতে রাখাইনের লড়াই বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও বঙ্গোপসাগরে প্রভাব ফেলবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মর্ত্তুজা খালেদ বলেন, আমার ধারণা মিয়ানমার রাষ্ট্র টিকবে না। কারণ এটা তো আর্টিফিশিয়াল স্টেট। ব্রিটিশরা এই অঞ্চলকে আর্টিফিশিয়ালি তৈরি করেছিল। এখানে একেক এলাকায় একেক জাতির বসবাস। রাখাইন রাজ্য কখনো মিয়ানমারের অংশ ছিল না, ইন্ডিয়ার অংশ ছিল। যেকোনো কারণেই হোক চলে গেছে মিয়ানমারে। এমন বহুজাতিক রাষ্ট্র টেকাতে হলে অবশ্যই সহনশীলতা দরকার।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, যুগোস্লাভিয়া তৈরি করেছিলেন মার্শাল টিটো। তিনি কিন্তু সহনশীলতার মাধ্যমে ধরেও রেখেছিলেন। একটা বহুজাতিক দেশকে ধরে রাখতে হলে নিপীড়ন না করা, ডমিনেট না করা উচিত। কিন্তু মার্শাল টিটোর মৃত্যুর পর কিন্তু যুগোস্লাভিয়া ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। মিয়ানমারের মতো বহুজাতিক রাষ্ট্রে নিপীড়ন নির্যাতনসহ ডমিনেট করতে চায়। এটা কী করে সম্ভব? এটা কি মধ্যযুগ? একটা রাষ্ট্র কীভাবে নিজ নাগরিককে নিপীড়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দিতে পারে? এতদিন পর্যন্ত প্রাচ্য শক্তি মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে টিকিয়ে রেখেছিল। বেশি করে চীন, রাশিয়াও। ভারতও সম্পদের লোভে বিরোধিতা করেনি।

গণতন্ত্রহীন, নিপীড়নমূলক সামরিক শাসন ব্যবস্থায় মিয়ানমার আর রাষ্ট্র হিসেবে টিকবে না উল্লেখ করে এ অধ্যাপক বলেন, সামরিকতন্ত্রে টেকা যায় না। অং সান সুচির হাতে ক্ষমতা থাকলে হয়ত মিয়ানমার টিকে যেত। কারণ নিপীড়ন নয়, বহুজাতিক রাষ্ট্রকে টেকাতে হলে দরকার সহনশীলতা। সহনশীলতা নেই বলেই আজকে মিয়ানমারের এই অবস্থা।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্বাস্তু হয়ে ঢল নামার সম্ভাবনা কম। কারণ আগের জান্তা সরকারের ওই পলিসি নেই। বদলে গেছে। আগে রাষ্ট্র শক্তিশালী ছিল। এখন বিদ্রোহীরা নানা অঞ্চল দখলে নিয়ে নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। আমার ব্যক্তিগত মত, বিদ্রোহীরা মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করতে পারলে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা নিজেরাই চলে যাবে স্বভূমিতে। এটাই বরং বাংলাদেশের জন্য ভালো। মিয়ানমার ভেঙে যাওয়া শুধু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্যই নয়, সারা বিশ্বের জন্যই ভালো।

গত ১ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) মিয়ানমারের চলমান সংকট নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে অনলাইনে যুক্ত হয়ে মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকারের (এনইউজি) প্রতিনিধি কিউ জ বলেছিলেন, সামরিক জান্তাকে হটাতে মিয়ানমারের ইতিহাসে এই প্রথম জনগণ এত প্রবলভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ফলে সেনাশাসককে না হটিয়ে জনগণ থামবে না। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে চীন নিজের স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখতে মিয়ানমারকে নিজের বলয়ে রাখতে চাইছে বলে সংকট আরও জটিল হয়ে পড়েছে।

এনইউজির প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ও মুখপাত্র কিউ জ বলেন, মিয়ানমারে সহিংসতা প্রতিদিনই বাড়ছে। অর্থনৈতিক সংকট চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে চলমান বসন্ত বিপ্লব সফল হবে, কারণ মিয়ানমারের জনগণ এখন ইতিহাসের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ। তিন বছর আগে মনে করা হয়েছিল, আসিয়ানের অন্যতম শক্তিশালী এই সেনাবাহিনীকে পরাজিত করা যাবে না। এখন প্রমাণ হয়েছে মিয়ানমারের জনগণ নৃশংস এই সেনাবাহিনীকে হটিয়ে দিতে সামর্থ্য রাখে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Discover more from ঝিনেদা টিভি

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading