রাজনীতি

বিএনপির শাহজাহান ওমর এখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী

“আমি নির্বাচনে যাচ্ছি, আওয়ামী লীগ যখন নৌকায় মনোনয়নের প্রস্তাব করছে, সেখানে আর প্রশ্ন কী? আমি স্বেচ্ছায় বিএনপি থেকে পদত্যাগ করছি,” বলেন শাহজাহান ওমর।

১৯৯১ সাল থেকে বিএনপির হয়ে চারটি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনবার জয় পাওয়া অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল শাহজাহান ওমর এবার ঝালকাঠি-১ আসন থেকে লড়তে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নৌকা নিয়ে।

বিএনপির বর্জনের মধ্যে আগামী ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা নাটকীয়তার মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘোষণাটি এল মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন বৃহস্পতিবার।

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষের ঘটনায় ৫ নভেম্বর গ্রেপ্তার হওয়া এই নেতা বুধবার হঠাৎ করে জামিন পেয়ে যাওয়ার পরেই তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে গুঞ্জন ছড়ায়।

সেই ঘটনায় গ্রেপ্তার বিএনপির নেতাদের মধ্যে শাহজাহান ওমরই একমাত্র নেতা, যিনি জামিন পেয়েছেন। বিকালে জামিন পাওয়ার পর সন্ধ্যাতেই তিনি মুক্তি পান।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান যে আওয়ামী লীগের হয়ে ভোটে যাচ্ছেন, সেই বিষয়টি বৃহস্পতিবার বিকালে জানা যায়। ক্ষমতাসীন দলের সভাপতি শেখ হাসিনার সই করা দলের মনোনয়নের টিকিটের ছবি ভাইরালও হয়ে যায়।

এরপর শাজহাজান ওমর সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি নিশ্চিত করেন, জানান তিনি বিএনপি ছেড়ে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়াও এই বিয়ষটি জানান গণমাধ্যমকর্মীদের।

গত রোববার আওয়ামী লীগ যে মনোনয়ন ঘোষণা করে তাতে ঝালকাঠি-১ আসন দেওয়া হয় তিনবারের সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুনকে। তবে শেষ বেলায় হাতে হতাশ হতে হয়।

মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের কারণে বীর উত্তম খেতাব পাওয়া শাহজাহান ওমর ১৯৯১ সাল থেকে বেশিরভাগ নির্বাচনেই বিএনপির হয়ে লড়াই করে আসছেন। কেবল তিনি ২০০৮ সালে মনোনয়ন পাননি।

১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের আবদুল কুদ্দুসকে হারিয়ে সংসসে আসেন তিনি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনে আবার জেতেন, তবে ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর কাছে হেরে যান অল্প ভোটে।

২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টির মঞ্জুকে হারিয়ে তিনি আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন্। ২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি আইন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।

তিনি আইন প্রতিমন্ত্রী থাকাকালেই বিচারপতিদের অবসরের বয়স সীমা দুই বছর বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময় আইনমন্ত্রী ছিলেন মওদুদ আহমদ।

এরপর সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতা তৈরি হয়। সে সময়ের বিধান অনুযায়ী সবশেষ প্রধান বিচারপতিরই এই পদ পাওয়ার কথা।

কিন্তু এক সময় বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক কে এম হাসানকে মেনে নিতে রাজি ছিল না আওয়ামী লীগ। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় জাতীয় পার্টি, ১৪ দল, বিকল্প ধারা ও এলডিপি।

এ নিয়ে আন্দোলনের এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ আহমেদ ২০০৮ সালের ২৮ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায় দেশ। ভোটের তারিখ ঘোষিত হয় ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি। আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মধ্যে ১১ জানুয়ারি জারি হয় জরুরি অবস্থা।

প্রায় দুই বছর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে শাহজাহান ওমরকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি সেই আসনে। হেরে যায় বিএনপি।

তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে ফের ধানের শীষ পান তিনি।

২০১৬ সালের জাতীয় সম্মেলনে শাহজাহান ওমরকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়। দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সঙ্গেও কাজ করেছেন তিনি।

গত ১৬ অক্টোবর রাজধানীতে এনপির উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দেশীয়-আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা‘ বিষয়ে এক সেমিনারে শাহজাহান ওমরের বক্তব্য ভাইরাল হয়ে যায়।

সেদিন তিনি ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে উদ্দেশ করে বলেন, “মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি আমাদের জন্য অবতার হয়ে এসেছেন। তার তো আমাদের আরো সাহস দেয়া দরকার, বাবারে তুই আমাদের বাঁচা, রক্ষা কর। তার বলতে হবে- আমি আছি তোমাদের সঙ্গে, তোমরাও ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি আমরাও ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি। পিটার হাস- বাবা ভগবান আসালামু আলাইকুম।”

গত ৫ নভেম্বর শাহজাহান ওমরকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব । তাকে ২৮ অক্টোবর কাকরাইল ও বিজয়নগর এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের দিন বাস পোড়ানোর মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২৪ দিনের মাথায় তার জামিন হয় বুধবার।

এর পরদিন নৌকার মনোনয়ন পাওয়ার পর শাহজাহান ওমর অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন বলে ঝালকাঠির রিটার্নিং কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম জানিয়েছেন।

শাহজাহান ওমর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত ১৭ বছর ধরে এলাকার কোনো কাজ করতে পারিনি। এলাকাবাসীর কাছে অনেক দায়বদ্ধতা আছে, সেই যায়গা থেকেই নির্বাচনে যাওয়া।

“আমি নির্বাচনে যাচ্ছি, আওয়ামী লীগ যখন নৌকায় মনোনয়নের প্রস্তাব করছে, সেখানে আর প্রশ্ন কী? আমি স্বেচ্ছায় বিএনপি থেকে পদত্যাগ করছি।”

মনোনয়ন জমা দিয়েছেন হারুনও

আওয়ামী লীগের টানা তিনবারের সংসদ সদস্য ও এবার প্রথমে নৌকার মনোনয়ন পাওয়া বজলুল হক হারুনও শেষ দিন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের টানা তিনবারের সংসদ সদস্য ও এবার প্রথমে নৌকার মনোনয়ন পাওয়া বজলুল হক হারুনও শেষ দিন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।

মনোনয়ন পরিবর্তন করে শাহজাহান ওমরকে প্রার্থী করার বিষয়ে হারুনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি, বারবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

হারুনের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ও রাজাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি আফরোজা আক্তার লাইজু বলেন, “আমি দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কিছুই বলব না। দল যাকে দল যাকে নতুন করে মনোনয়ন দিয়েছে আমিসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ তার নির্বাচন করব।”

দলের প্রার্থী হতে না পেরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সদস্য মনিরুজ্জামান মনিরও।

সব মিলিয়ে আসনটিতে ১১ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।

অন্যরা হলেন ভোটে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিএনপির নির্বাহী কমিটি থেকে বহিষ্কৃত ব্যারিস্টার আবুল কাশেম ফখরুল, সাংস্কৃতিক পার্টির মামুন সিকদার, তৃণমূল বিএনপির জসীম উদ্দিন, জাকের পার্টির আবু বকর সিদ্দিক, জাতীয় পার্টির ইজাজুল হক, স্বতন্ত্র মজিবর রহমান, নুরুল আলম, মো. ইসমাইল।

বিএনপি ভোটে আসবে না সিদ্ধান্তে অটল থাকার সময় ব্যারিস্টার ফখরুলসহ দলের নির্বাহী কমিটির যে দুইজন সদস্য নির্বাচনের আগ্রহ দেখান, তাদের একজন ব্যারিস্টার ফখরুল। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ছিলেন। তার রায় ফাঁস মামলায় সাজাও খেটেছেন।

ফখরুল সাংবাদিকদের বলেন, “কোনো চাপে নয় নিজ ইচ্ছায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Discover more from ঝিনেদা টিভি

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading